বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আজ : আশার মাঝেও অনিশ্চয়তা

ফাইল ছবি

ডেস্ক রিপোর্ট – সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ ২২ আগস্ট বৃহস্পতিবার থেকেই বহুল আলোচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। গত বছরের ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২২ আগস্ট আবারও প্রত্যাবাসন শুরুর দিন ঠিক করেছে। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরতে রাজি হলেই কেবল বাংলাদেশ তাদের পাঠাতে চায়। বাংলাদেশ স্পষ্ট বলেছে, কাউকে জোর করে পাঠানো হবে না।

জানা যায়,সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা সত্তেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর অনিশ্চয়তা কাটেনি। তবুও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত পাঠাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্ত ৩ হাজার ৪৫০ জনের মধ্যে দুই শতাধিক পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে।

এতে রোহিঙ্গারা সরকার ও জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিদের সামনে তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী কি না, সে বিষয়ে মত দিয়েছেন।

সরকার বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসন শুরুতে আগ্রহী হলেও এখনই চায় না এনজিওগুলো। তারা প্রত্যাবাসন শুরুতে আপত্তি জানিয়েছে।

জানা গেছে, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করাসহ বেশকিছু দাবি পেশ করেছে।

এদিকে বুধবার ৬১টি এনজিও এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। এতে তারা বলেছে, মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনবিষয়ক সাম্প্রতিক খবরে শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত। এনজিওগুলো মিয়ানমারে পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা ব্যক্ত করে নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নিশ্চিতের আহ্বান জানিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে এনজিওগুলো নিরুৎসাহিত করছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন অভিযোগ করার পর প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি সম্পাদনের মধ্যেই তারা এ বিবৃতি দিয়েছে।

ঢাকার সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যাবাসন শুরুর ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার বদ্ধপরিকর। তবে এ বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন সামনে রেখে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়া শুরু করার আগ্রহ দেখিয়েছে। চীন ও ভারত প্রত্যাবাসনের পক্ষে।

নিউইয়র্কে বাংলাদেশি এক কূটনীতিক বলেছেন, প্রত্যাবাসন শুরু করতে না পারলে মিয়ানমার জাতিসংঘে বাংলাদেশকে দোষারোপ করবে। এদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি পরস্পরকে দোষারোপের খেলায় হারিয়ে যাবে। ফলে ফেরার কার্যক্রম শুরু করাটা খুবই জরুরি। ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ কিংবা ২৮ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেবেন। তিনি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

এদিকে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার প্রথম থেকেই বলে আসছে কোনো রোহিঙ্গাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে পাঠানো হবে না।

তবে, বুধবার পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ১ হাজার ৩৩ পরিবারের মধ্যে যে ২৩৫ পরিবার ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছে- তাদের মধ্যে প্রায় সবাই মিয়ানমারে ফিরবে না বলে মত দিয়েছে। আবার তালিকাভুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ মিয়ানমারে যেতে রাজি হলেও রোহিঙ্গা নেতাদের চাপে না বলতে বাধ্য হচ্ছেন। এরপরও যারা রাজি হচ্ছেন তাদের ক্যাম্প থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে প্রত্যাবাসন বিরোধী চক্র।

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভোরের কাগজকে বলেন, রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। তারা রাজি থাকলে বাসে করে ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এজন্য ঘুমধুম সীমান্তে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নেয়া হয়েছে। তবে, রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হচ্ছে না।

ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়।

এদিকে, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা বলছেন, কোন ভরসায় তারা মিয়ানমারে যাবে? যে নির্যাতনের শিকার হয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, আবারো সেই নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে- এমন ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।

তবে, মিয়ানমার সরকার যদি তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাগরিকত্ব দেয়, মিয়ানমারে চলাফেরা করার স্বাধীনতা দেয়, রোহিঙ্গা হত্যার বিচার করে, সেখানে জেলে বন্দি থাকা রোহিঙ্গাদের মুক্তি দেয় এবং তাদের বসতভিটা ফেরত দেয়- তাহলেই ফিরতে রাজি তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ৩ হাজার ৪৫০ জন রোহিঙ্গা টেকনাফের ২৪, ২৫, ২৬, ২৭ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। তবে, নয়াপাড়ার ২৬ ও জাদিমুড়ার ২৭ নম্বর ক্যাম্পে অবস্থান করছেন ৩ হাজার ৩০০ জন রোহিঙ্গা। এজন্য ক্যাম্প দুটির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে ইউএনএইচসিআর এবং শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এজন্য গত মঙ্গলবার ও বুধবার ২৩৫ পরিবারের মতামত জানা হয়েছে।

তবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা মিয়ানমার ফিরবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই-৩ ব্লুকের বাসিন্দা মো. আলম বলেন, আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে মিয়ানমার ফিরতে চাই কিনা। আমি একবাক্যে ‘যাব না’ বলে জানিয়ে এসেছি। কারণ যে নির্যাতনের শিকার হয়ে আমরা নিজ দেশ ছেড়ে এসেছি আবার সেই নির্যাতনের মুখে পড়তে চাই না।

এক প্রশ্নের জবাবে শরণার্থী বলেন, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমরা খুব ভালো আছি। এই সুখের জায়গা ছেড়ে সন্তানদের হুমকির মুখে ঠেলে দিতে চাই না। তবে, মিয়ানমার সরকার যদি আমাদের নাগরিকত্ব দেয়, চলাফেরার স্বাধীনতা দেয় তাহলে ফিরতে আপত্তি নেই। যতই হোক এটি পরের দেশ। নিজেদের ভিটেমাটিতে শান্তিতে থাকার ইচ্ছা সবারই আছে।

ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে সাক্ষাৎকার দিয়ে বের হয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, তালিকাভুক্ত অনেকেরই মিয়ানমারে ফেরার ইচ্ছা আছে। তবে, রোহিঙ্গা নেতারা বাড়িতে এসে জানিয়ে গেছে ক্যাম্প ইনচার্জের কার্যালয়ে গিয়ে যেন বলি, ‘আমরা মিয়ানমারে ফিরতে রাজি নই’। তাই আমরা ফিরতে রাজি নই বলে জানিয়ে এসেছি। কারণ এরপরও যদি ফেরার কথা বলি; তাহলে আমাদের ক্ষতি হতে পারে।

অন্যদিকে, ক্যাম্প ইনচার্জ কার্যালয়ে কর্মরত এনজিও কর্মীদের সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্তদের মধ্যে ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ই ব্লুকের কয়েকটি পরিবার মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হয়েছে। পরে দুপুরে ওই বাড়িগুলোতে গেলে সেগুলো ফাঁকা পাওয়া যায়।

রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, মিয়ানমারে যেতে রাজি হওয়ায় তাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে প্রত্যাবাসন বিরোধী প্রভাবশালী রোহিঙ্গাচক্র।

উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, টেকনাফ ও উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের অবস্থান এখন বেশ শক্ত। তারা খাবার, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটসহ যে নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে তেমনটা স্থানীয়রাও পাচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবেও রোহিঙ্গারা এখন এগিয়ে। প্রতিটি ক্যাম্পে বড় বড় বাজার গড়ে উঠেছে। এখানে তারা নিজস্ব সমাজব্যবস্থাও চালু করেছে। ফলে এমন জীবন ছেড়ে কেউ অনিশ্চিত জীবনে যেতে চাচ্ছে না। মূলত এ কারণেই রোহিঙ্গাদের ফেরানো যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কমিশনার আবুল কালাম বলেন, মঙ্গলবার ২১ ও বুধবার ২১৪ পরিবারের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের পরিবহনের জন্য পাঁচটি বাস ও তিনটি ট্রাকের ব্যবস্থাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আমরা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আশাবাদী। ইতোমধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য মিয়ানমার ও চীনের তিনজন পর্যবেক্ষক নিয়োগ করা হবে। তারা ইতোমধ্যে কক্সবাজারে অবস্থান করছেন। এখন শুধু রোহিঙ্গারা রাজি থাকলে ২২ আগস্ট থেকেই প্রত্যাবাসন শুরু হবে।